আধুনিক বিশ্বে ইসলামি দাওয়াহ-এর মাধ্যমসমূহ সংক্ষেপে লিখ
উত্তর: আধুনিক বিশ্বে ইসলামি দাওয়াহ-এর মাধ্যমসমূহ
বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে মানুষের জীবনচিত্রও বদলেছে। আগের দিনের মানুষে হারিকেনের আলোতে লেখাপড়া করত আর এখন বিদ্যুত বিনে কল্পনাও করা যায় না। পানি জাহাযে করে মাসাধিককাল সময় সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যেত হজ্জ করতে। আর এখন মাত্র ৬ ঘন্টায় উড়াল জাহাযে চড়ে পৌঁছে যায় পবিত্র নগরী মক্কায় মহান রবের সান্নিধ্যে। আগে টেলিগ্রামের মাধ্যমে যরূরী বার্তা প্রেরণ করা হ’ত, আর এখন বাটন চাপলেই মুহূর্তে কথা হয় হাযার হাযার মাইল দূরে থাকা স্বজনের সাথে। আগে মানুষ রানারের পথপানে তাকিয়ে থাকত গভীর আগ্রহ নিয়ে, কখন আসবে স্বজনের চিঠি, জানবে সব বৃত্তান্ত। আর এখন এসএমএস, ম্যাসেঞ্জার, ই-মেইল, ফেইসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে সেকেন্ডেই হচ্ছে সংবাদ আদান-প্রদান। এক কথায়, সারা পৃথিবী এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলা হয়। বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে বেশ। আগে যেখানে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে বা অন্য কোন যানবাহনে চড়ে গিয়ে দাওয়াত দিতে হ’ত। এখন সেখানে ঘরে বসেই কম সময়ে আরো অধিক সংখ্যক লোকের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানো যায় সহজে। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আজ অসম্ভব যেন সম্ভব হচ্ছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ। এ পর্যায়ে আমরা দাওয়াতের কিছু আধুনিক মাধ্যম সম্পর্কে আলোকপাত করব।-
ইন্টারনেট :
ইন্টারনেট
(Internet) অর্থ- আন্তর্জাল। এ মাধ্যমটি নেট বা জালের মত গোটা পৃথিবীকে এক সূতায় গেঁথে দিয়েছে। এর ফলে বিশ্বের এক প্রান্তে কোন ঘটনা ঘটলে সেকেন্ডের মধ্যে তা পৃথিবীর অপর প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে এখানে কোন ভিডিও বা লেখনী পোস্ট করা হ’লে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে তা দেখা সম্ভব হচ্ছে।
ফলে আধুনিক যুগে বিশুদ্ধ দাওয়াত প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। এতে থাকা বিভিন্ন মাধ্যম যেমন ওয়েবসাইট, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ সাইট ইত্যাদির মধ্যমে খুব স্বল্প সময়ে, অল্প কষ্টে অসংখ্য মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রচার করা যায়। নিম্নে এমনই কিছু মাধ্যম সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-
১. ওয়েবসাইট (website) :
নিজের তথ্যকে অন্যের নিকটে তুলে ধরার অত্যন্ত সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটকে একটি গৃহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেখানে নানা ধরনের আসবাবপত্র পরিপাটি করে সাজানো থাকে। ওয়েবসাইটও ঠিক তাই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সকল তথ্য সেখানে সংরক্ষিত থাকে।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসলামিক এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে, যা শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, প্রশ্নোত্তর, ইসলামিক বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা দ্বারা সমৃদ্ধ। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়েও লেখা থাকে সেখানে। এসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দ্বীনের পথে উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং আখেরাত নির্ভর জীবন গঠনে উৎসাহিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, ভাল-মন্দ দুই ধরনের ওয়েবসাইটই আছে ইন্টারনেটে। আমাদেরকে অবশ্যই ভালটা গ্রহণ করতে হবে এবং মন্দ সাইট থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আবার ভাল-র মধ্যেও কিছু সাইট আছে, যেখানে শিরক-বিদ‘আত মিশ্রিত দাওয়াত দেওয়া হয়। সেগুলো থেকেও বেঁচে থাকা যরূরী।
২. ইউটিউব : বর্তমান ইন্টারনেট জগতের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং সাইট হচ্ছে ইউটিউব। ২০০৫ সালে ইউটিউবের যাত্রা শুরু হয়। ইউটিউবের রয়েছে নানাবিধ সুবিধা। এর মাধ্যমে একটি একাউন্ট খুলে যে কোন ভিডিও আপলোড করা যায়। ভিডিও এডিট করার সুবিধাও রয়েছে ইউটিউবে। কত মানুষ ভিডিওটি দেখছে তার হিসাবও ইউটিউব করে দেয়। ফলে সহজেই জানা যায় আপলোডকৃত ভিডিউটির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে। সেই সাথে দর্শক-শ্রোতারা কমেন্ট করে জানাতে পারেন ভিডিউটির বা বক্তব্যটির ভাল-মন্দ দিক, দিতে পারেন পরামর্শও। পরবর্তী ভিডিও তৈরীর ক্ষেত্রে যা গাইড হিসাবে কাজ করে। তবে এ ক্ষেত্রে মন্দ দিক হচ্ছে ভিন্ন মতের কারো ভাল কথা, নছীহত বা উপদেশকেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ও বাজে মন্তব্য করা। যা মোটেই সমীচীন নয়।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ইউটিউব টেলিভিশনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বলা চলে এখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউটিউব চ্যানেল। কেননা ইউটিউব সহজলভ্য একটি ইন্টারনেট সাইট। টেলিভিশনের চেয়ে বহুগুণ বেশী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এখানে। ইচ্ছা করলে যখন তখন ঢুকে কাঙ্ক্ষিত ভিডিও দেখা যায়, পসন্দের আলোচকের আলোচনা শ্রবণ করা যায়। তাছাড়া ইউটিউব চ্যানেল খুব সহজেই খোলা যায়। এখানে সরকারী অনুমতিরও প্রয়োজন হয় না। ধরনা দিতে হয় না মন্ত্রণালয়ের দুয়ারে দুয়ারে। ব্যয় করতে হয় না মোটা অংকের অর্থ।
দাওয়াতের একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে ইউটিউব। ঘরে বসে যে কোন বিষয়ে দ্বীনী নছীহত ভিডিও করে আপলোড করে দিলে অথবা কোন ইসলামী মজলিসের বক্তব্য বা জুম‘আর খুৎবা ইউটিউবে প্রচার করলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেটি দেখতে পায়। তাছাড়া লাইভ ভিডিওতে গিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের দ্বীন বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। এভাবে ইউটিউবের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত অতি সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
৩. ফেইসবুক :
দাওয়াতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক মাধ্যম হচ্ছে ফেইসবুক (Facebook)। ফেইসবুক হচ্ছে বিশ্ব সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট। বর্তমান শতাব্দীর পূর্বে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। এ রকম আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ সাইট তৈরী হবে মানুষ হয়ত কল্পনাও করেনি। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে ফেইসবুক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জনৈক আমেরিকান মার্ক জাকারবার্গ হচ্ছেন এর প্রতিষ্ঠাতা।
বর্তমানে সব বয়সের মানুষই এ মাধ্যমটি ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীর তিনভাগের একভাগ তথা ২৬০ কোটি মানুষ বর্তমানের এ মাধ্যমটির গ্রাহক। এর মাধ্যমে যেকোন রচনা, ছবি, ভিডিও এমনটি লাইভ ভিডিও খুব সহজেই অন্যের সাথে বিনিময় করা যায়। ফলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে।
ফেইসবুকে খুব সহজেই নিজস্ব পেজ অথবা গ্রুপ খুলে বা কোন ইসলামী গ্রুপে যুক্ত হয়ে দ্বীনী বিষয়ে বিভিন্ন পোস্ট করা যায়।
৪. এ্যাপস :
‘এ্যাপ’ হচ্ছে ‘অ্যাপ্লিকেশন’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি এক ধরনের সফটওয়্যার, যা পৃথক পৃথক প্লাটফর্মে চলতে পারে। যেমন- মোবাইল এ্যাপ, ডেক্সটপ এ্যাপ ও ওয়েব এ্যাপ। এর মধ্যে মোবাইল এ্যাপ সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচালনায় সহজ। কল করা, ছবি তোলা, ভিডিও করা, যোগাযোগ করা, হিসাব করা, গেমস খেলা ইত্যাদি বহু কাজে ব্যবহৃত হয় এ্যাপ।
অনুরূপভাবে দাওয়াতী কাজেও এ্যাপের ব্যবহার কম নয়। ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ের রয়েছে এ্যাপ। যেমন কুরআন এ্যাপ, হাদীছ এ্যাপ, অডিও-ভিডিও-র এ্যাপ, বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও সংস্থা বা ইসলামিক পত্রিকার এ্যাপ, ফৎওয়া এ্যাপ ইত্যাদি।
৫. মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, টেলিগ্রাম প্রভৃতি : এগুলো জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত এ্যাপস। দাওয়াতের ক্ষেত্রে এই এ্যাপসগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই এ্যাপসমূহে গ্রুপভিত্তিক দাওয়াতী কাজ করা যায়। অডিও-ভিডিও আপলোড করা, টেক্সট মেসেজ বা ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া যায়।
৬. ভিডিও কনফারেন্স : ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রোতাকে সংযুক্ত করে সরাসরি দাওয়াত দেওয়া যায়। এর মাধ্যমে শ্রোতারা যেমন বক্তাকে দেখতে পান, তেমনি বক্তাও শ্রোতাদের দেখতে পান। এতে শ্রোতারা সরাসরি প্রশ্নও করতে পারেন।
অনলাইনে দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে সতর্কতা :
অনলাইনে দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যেমন-
(১) কোন বিষয় উপস্থাপনের পূর্বে তা বিশুদ্ধ আক্বীদা ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক কি-না তা যাচাই করতে হবে। কারণ এই পোস্টের ফলে একজন মানুষও যদি শরী‘আত বিরোধী কোন আক্বীদা বা আমলে অভ্যস্ত হয়, তবুও সে পাপের বোঝা পোস্টদাতার আমলনামায় যুক্ত হবে।[7]
(২) কারু মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা বা কটূ কথার জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বদা মধ্যমপন্থা বজায় রাখবে, ইসলামী আদব রক্ষা করবে। কখনোই মন্দের প্রতিবাদ মন্দ দিয়ে করা যাবে না। এতে আল্লাহর রহমত হবে ও দাওয়াতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
(৩) ফেইসবুক, ইউটিউবসহ অনলাইন দাওয়াতের মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন, ছবি ও ভিডিও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সেকারণ এসব থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা রাখতে হবে। যেমন ব্রাউজার-এ এ্যাড ব্লক সফটওয়্যার ব্যবহার, ইউটিউবের জন্য restricted mode অপশন চালু রাখা ইত্যাদি।
দাওয়াতের প্রচার-প্রসারে সহযোগিতা করা :
অনেক ভাই আছেন, বিশুদ্ধ দাওয়াত প্রচারের ক্ষেত্রে যাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। সেক্ষেত্রে তারা অন্য কারো দাওয়াতকে সমাজের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একই নেকী লাভ করতে পারেন। যেমন-
বিশুদ্ধ আক্বীদা-আমল সমৃদ্ধ বক্তব্য সংগ্রহ করে বা এরূপ বই-পত্র স্ক্যান করে অনলাইনে বা মেমোরী কার্ডের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।
অনেকের অধ্যয়নের অভ্যাস বা সক্ষমতা না থাকায় তারা অডিও-ভিডিওর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকে। তাদের জন্য ইসলামী বই সমূহের অডিও বুক তৈরী করে প্রচার করা।
বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী বিদ্বানদের বই-পত্র ও বক্তব্যসমূহ অনুবাদ বা ডাবিং করার মাধ্যমে নিজ ভাষাভাষী মানুষের মাঝে তা ছড়িয়ে দেয়া।
উপসংহার : পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। আর এজন্য কুরআন ও হাদীছে বার বার দাওয়াতের প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, একটি আয়াত হ’লেও পৌঁছে দিতে। আলোচ্য নিবন্ধে দাওয়াতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এবং দাওয়াতী কাজে ব্যবহৃত আধুনিক কিছু মাধ্যম তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি উক্ত আলোচনা থেকে পাঠকহৃদয়ে নতুন করে দাওয়াতের প্রতি দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হবে এবং স্ব স্ব অবস্থান থেকে সকলে সাধ্যমত দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিবেন ইনশাআল্লাহ।
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url